হারুকাকা - Haru Kaka


হারুকাকা কে চেনেন না বোধ হয়! আমাদের পাশের পাড়াতেই দেখতাম আগে। ওখানে থাকে কিনা জানিনা! তবে অনেকবার দেখেছি ঘোরাঘুরি করতে। বিশেষ করে নেমন্তন্ন বাড়িতে দেখতে পেতাম ই। খেতে দিচ্ছে, জল দিচ্ছে, এঁটো পাতা তুলছে। আমার কেমন একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল হারুকাকা বোধ হয়, ক্যাটারিং এ কাজ করে। মানে ঐ যারা রান্নাবান্নার কাজ করে। তখন বয়েস কত আমার!? ঐ দশ এগারো হবে। অনেক আগের কথা। আমাকে দেখলেই হারুকাকা পকেট থেকে দশ পয়সার লজেন্স বার করে দিত। ঝোলা পাঞ্জাবি পরতো কাকা আর লুঙ্গি। বলতো, খোকা লজেন্স খাও, পেট ভরবে! লজেন্স খেয়ে কিভাবে পেট ভরে সেটা খুঁজে পেতাম না।
হাইস্কুলে পড়ি তখন। বাবা কাজের সূত্রে বাইরে থাকেন। বাড়িতে আমি, মা, আর ঠাকুমা আরও বাকিরা । আমি তখন সেভেন এ পড়ে আর বোন ফাইভে। দুই ভাইবোন  মোট একটাকা হাত খরচা পেতাম। বোন পঞ্চাশ পয়সা আর আমি পঞ্চাশ পয়সা। বোন তাই দিয়ে মশলা মুড়ি খেত আর আমি লজেন্স খেতাম। পঞ্চাশ পয়সায় পাঁচটা হত লজেন্স। সেই লজেন্স খেতে খেতে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। একদিন দেখি হারুকাকা লজেন্সের দোকান নিয়ে বাইরে বসে। আমাকে দেখেই হাঁক দিল, “খোকাবাবু বুঝি এই ইস্কুলে পড়ো ? বেশ বড় ইস্কুল তো!” বললাম, “হ্যাঁ ! কাকা তুমি বুঝি রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছ ?” কাকা উত্তর দিলে না। খালি হেসে আমার হাতে লজেন্স দিয়ে বললো, লজেন্স খাও ছোটখোকা! লজেন্স নিয়ে চুপচাপ বাড়ি চলে এলুম। পরের দিন স্কুলে গিয়ে দেখি কাকার দোকান নেই। পাশের দোকানদার কে জিগ্যেস করলাম। বলে, হারুর কোনো ঠিক থাকেনা। যা ইচ্ছে করে। কে জানে কই গেছে! তবে বৌ অন্ত প্রাণ হারু!
আমাদের পাড়া থেকে কিছু দূরে নডরা। বড় রথ হয় ওখানে। জগন্নাথের মন্দির আছে বেশ বড়। বড় মেলা বসে। কাকার’র সাথে রথটানা দেখতে গেছি। দেখি হারুকাকা রথের দড়ি ধরে টানছে। আমি আর কাকা প্রসাদ খেলাম। হারুকাকাও দেখি দু’প্লেট প্রসাদ নিল। আমি কাছে গিয়ে বললাম, হারুকাকা তুমি বুঝি দু’বার খাবে? স্বভাবসিদ্ধ ভাবে হারুকাক লজেন্স দিল আমায়। দিয়ে বললো, নাগো খোকাবাবু, দু’জন খাবে। বলে হেসে চলে গেল কাকা।
কাকা দেখেছিল আমাকে কথা বলতে। আমি ফিরে আসতে বলে, তুই হারুকে চিনিস বুঝি? বললাম, লজেন্স দেয় তো! কাকা অবাক চোখে আমাকে তাকিয়ে বললো, খিদে বড় বালাই রে ! কোনো কিছুই তার আগে দাঁড়াতে পারেনা! আমি চুপ করে রইলাম। আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে একথা বোধগম্য হলোনা। সেই সেখানে আমাদের এলাকাতে শেষ দেখা আমার সাথে হারুকাকার। আর দেখা হয়নি।

শহরের বদ্ধ পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। এমনিও শহরটা খুব চেনা না আমার। কেবল মেস চিনি, কলেজ আর শাহিদের বাড়ি! কলেজের ফাইনাল ইয়ার দিয়েছি সবে। মেসে থাকি। একমাত্র বন্ধু শাহিদই যা ভরসা এত বড় শহরে! মুসলিম ছেলে। জাতপাত আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে আসেনা কখনো। উচ্চবিত্ত পরিবার ওদের। ঈদের দিনে বাইরের বাগানে রীতিমত লোকেদের খাওয়ায়। বিরিয়ানী। গরীব ক্ষুধার্তেরা আসে দু’মুঠো খাবারের আশায়। শাহিদের বাবা বলেন, ক্ষুধার্তের মুখে খাবার তুলে দেবার মত পাক কাজ নাকি আর কিছুই নাই।
ঈদের দিন, বড় খুশির দিন। প্রত্যেক বছরের মত এবারো সকাল থেকে শাহিদের বাড়িতে নেমন্তন্ন আমার। বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে লোকেদের লাইন দিয়ে খাওয়া দেখছিলাম। হঠাৎ নজর পড়লো একটা কাঁচাপাকা চুলের প্রায় বৃদ্ধের উপর। লুঙ্গি আর ঝোলা পাঞ্জাবি পরা, মাথায় ফেজ টুপি পরা। এ চেহারা আমার ভুল হবার নয়। এক কোণে দাঁড়িয়ে খাচ্ছিলেন উনি। আর দু’পকেট ভরে ঠুসছিলেন বিরিয়ানী। জেদ চেপে গেল আমার। আজ জানতেই হবে হারুকাকা কার জন্যে খাবার নিয়ে যায়। আমি জিগ্যেস করবো ভেবে এগোলাম। চোখে চোখ পড়লো হারুকাকার। উধাও হয়ে গেলেন যেন একেবারে। আজ বার করতেই হবে। গেটের বাইরে এলাম কাউকে না বলে। দেখি ত্রস্ত পায়ে একরকম দৌড়াচ্ছেন হারুকাকা। কিছুদুর গিয়ে একটা প্রায় অন্ধকার গলিতে ঢুকলেন। হারিয়ে গেলেন একরকম। আমি গলি ধরে এগোতে থাকলাম। কুকুরের চিৎকার ভেসে আসলো হঠাৎ। খানিক ভয় লাগলো আবার। কি জানি পাগলা কুকুর হয় যদি! আবার কামড়ে না দেয়! নাহ্‌ যা হয় হবে, আজ জানবোই! এগিয়ে দেখি হারুকাকার পাঞ্জাবির একদিক ছেঁড়া বিরিয়ানি ছড়িয়ে পড়ে আছে রাস্তায়। বাঁ হাতে রক্ত, কুকুরে কামড়েছে বোধহয়। আর একদিকের পকেট শক্ত করে ধরে রেখেছেন কাকা। আমি ডাক দিলাম, “হারুকাকা...” কাকা পেছন ফিরে আমাকে দেখেই দৌড়ালো সামনের গলি ধরে। আমি আরো জোরে ডাক দিলাম। লাভ হলোনা। হারুকাকা হারিয়ে গেল।
পাশের ভাঙা চায়ের দোকান থেকে একজন মাঝ বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলেন। আমায় বললেন, বাবু তুমি বুঝি হারাধন কে চেন? আমি অবাক হয়ে চাইলাম। সেই প্রথম জানতে পারলাম হারুকাকার আসল নাম হারাধন! ওনাকে বললাম, একগ্লাস জল হবে? উনি আনতে গেলেন।
পেছন থেকে শাহিদ এসে পড়লো। সাথে ওদের মালী। এসেই রেগে বলে, "কি বেআক্কেলে ছেলে তুই?? অচেনা জায়গায় কেউ এরকম বেরিয়ে আসে? নেহাত মালীকাকা দেখেছে তুই হারেস চাচাকে ফলো করে বেরিয়েছিস! নইলে খুজতে মাথা খারাপ হতো।" আমার মাথা খারাপ হতে শুরু করলো।
দোকানদার জল নিয়ে আসলো। আমি খেয়ে উঠে তাকে জিগ্যেস করলাম হারুকাকার ব্যাপারে। উনি যা বললেন তার মানে এই, হারুকাকা তার বৌকে নিয়ে গলির ওপাশে বস্তিতে থাকে। বৌ অন্ত প্রাণ। এদিক ওদিক ফাই ফরমাশ খাটে। কিছু খাবার পেলেই সন্তুষ্ট। আমি ফিরে শাহিদদের মালীকে জিগ্যেস করলাম, হারেস চাচার সম্বন্ধে কি জানে? একই কথা বললে সেও। আমি খুঁজে খুঁজে হারুকাকার ঘরটা পেলুম। ভাঙা দরজা আর নোংরা পরিবেশ। ভেজানো ছিল দরজা। ফাঁক দিয়ে দেখলুম। রক্তমাখা হাতে কাকিমা কে জড়িয়ে ধরে খাইয়ে দিচ্ছে কাকা। বুঝলুম কাকিমার বোধহয় প্যারালিসিস। একরাশ ভালোবাসা দেখে চোখ জলে ভরে গেল আমার। দরজা থেকে সরে এসে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম।
বহুবছর কেটে গেছে তারপর। জানিনা হারু কাকা কেমন আছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা, কাকিমা বেঁচে আছে কিনা! জানতে ইচ্ছেও করেনা হারুকাকা কে ছিল? শ্রী হারাধন নাকি সেখ হারেস! অনতিদূরের মসজিদ থেকে যখন আজান ধ্বনি ভেসে আসে আর পাশের মন্দির থেকে আরতির শাঁখ কাঁসর এর আওয়াজ, তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, খিদের জ্বালার সামনে সব মিথ্যে; আর ভালোবাসার শক্তির কাছে সবকিছুই বড্ড ছোট।

Jiban

Comments

Popular posts from this blog

Swadinota

The Art of Story-Telling by Richard Steele