বন্ধুত্ব

ছেলেবেলা! স্কুল শুরুর দিনগুলোতে আমাদের অনেকেরই নতুন অভিজ্ঞতার নাম হয়তো একটাই, বন্ধুত্ব! পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে চেনা জগত্টা যে এক লাফে অনেক দূর চলে গিয়েছিল সে তো বন্ধুদের হাত ধরেই। জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে আজ যে যেখানেই থাকি না কেন চলার পথে বন্ধুত্ব নামের এই পাথেয়টির তুলনা বোধ হয় আর কিছুর সঙ্গেই চলে না। এ এমনই বিষয় যেন কিছু না থাকলেও বন্ধুত্ব থাকলে চলে আবার সব থাকলেও বন্ধুত্ব ছাড়া চলে না!


নানা সংস্কৃতিতে, নানা দেশে বন্ধুত্বের রীতিনীতিতে আগেও যেমন ভিন্নতা ছিল, এখনো তেমনি ভিন্নতা আছে। কিন্তু বন্ধুত্ব তো তাই যাকে কোনো নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না, সংজ্ঞা দিয়ে বাঁধা যায় না। হয়তো তার প্রয়োজনও নেই। তবু মানুষ যুগে যুগে দেশে দেশে বন্ধুত্বকে যেমন উদযাপন করেছে তেমনি একে ব্যাখ্যা করারও চেষ্টা করেছে। আগস্ট মাসের প্রথম রোববারের হিসেবে আজ ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস’। বন্ধুত্ব নিয়ে নানা দেশের কয়েকজন মনীষীর কিছু উক্তি আর কথকতা নিয়ে সাজানো এ প্রতিবেদন।

এমন এককাল তো ছিলই যখন ‘ছেলেতে-মেয়েতে’ বন্ধুত্ব হলে তা কেবল ভালোবাসা-প্রেমের সম্পর্ককেই বোঝাত! কিন্তু এই যুগ সেসব পেছনে ফেলে অনেক দূরই এগিয়েছে। তবু বিষয়টি আরও স্পষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা দিয়ে শুরু করা যেতে পারে—‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুই জন ব্যক্তি ও একটি জগত্। অর্থাত্ দুই জনে সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা। আর, প্রেম বলিলে দুই জন ব্যক্তি মাত্র বুঝায়, আর জগত্ নাই। দুই জনেই দুই জনের জগত্।’

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এ লেখা থেকেই আরও উল্লেখ করা যেতে পারে—‘ইহা ছাড়া আর একটা কথা আছে—প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।’


বাঙালি রবীন্দ্রনাথ দুই বন্ধুতে মিলে সহযোগী হওয়ার কথা বলেছেন এবং প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরকে পরস্পরের জগত্ বলে হাজির করেছেন। এ ভাবনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে স্পেনীয়-কিউবান বাবা-মায়ের সন্তান ফরাসি দেশে জন্মানো লেখিকা আনাইস নিনের একটা উক্তিকে। নিন বলেছেন, ‘একেক বন্ধু আমাদের মধ্যে একেকটা দুনিয়ার প্রতিফলন, হয়তো সে আসার আগ পর্যন্ত ওই দুনিয়াটাই জন্মায় না। আর কেবল বন্ধুর সঙ্গে মিলনের মধ্য দিয়েই ওই দুনিয়া জন্মাতে পারে।’

এমন বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যে, ছেলে-ছেলে, মেয়ে-মেয়ে কিংবা ছেলে-মেয়েতে বন্ধুত্বে কোনো ফারাক থাকে না সে কথাটি বোধ হয় আমরা আরেক বাঙালি কাজী নজরুল ইসলামের বন্ধুত্বের গল্প থেকে জেনে নিতে পারি। বন্ধু মোতাহার হোসেন চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে নজরুল নিজের আবেগকে এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন, ‘...আমার চোখের জলের মতিহার, বাদল রাতের বুকের বন্ধু। যেদিন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর আর সবাই আমায় ভুলে যাবে, সেদিন অন্তত তোমার বুক বেঁধে উঠবে। ... কেন এই কথা বলছি শুনবে? বন্ধু আমি পেয়েছি যার সাক্ষাত্ আমি নিজেই করতে পারব না। এরা সবাই আমার হাসির বন্ধু, গানের বন্ধু, ফুলের সওদার খরিদ্দার এরা। এরা অনেকেই আমার আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছে, প্রিয় হয়ে ওঠেনি কেউ। আমার জীবনের সবচেয়ে করুণ পাতাটির কথা তোমার কাছে লিখে গেলাম। আকাশের সবচেয়ে দূরের যে তারাটির দীপ্তি চোখের জলকণার মতো ঝিলমিল করবে, মনে কর, সেই তারাটি আমি। আমার নামেই তার নামকরণ কর, কেমন?’

বন্ধুর সঙ্গে মিলে, বন্ধুর কাঁধে কাঁধ হাতে হাত রেখেই তো দুনিয়া দেখতে হবে। এজন্যই বোধ হয় ইংরেজ লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ বলেছিলেন, ‘কেউ কেউ পুরোহিতের কাছে যায়; কেউ কবিতার কাছে; আমি যাই বন্ধুর কাছে।’ আর আইরিশ কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক সি জি লিউইস বলছেন, ‘বন্ধুত্ব হল দর্শন কিংবা শিল্পকলার মতোই একটা অপ্রয়োজনীয় বিষয়...এর অস্তিত্বগত কোনো মূল্য নেই; এটা বরং এমন বিষয়গুলোর একটা যা অস্তিত্বকে মূল্যবান করে তোলে।’

এভাবে দুনিয়ার অনেক মনীষীই বন্ধুত্বকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। গ্রিক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন, ‘বন্ধু হতে চাওয়া একটা ক্ষণিকের কাজ, কিন্তু এটা এমন ফল যা খুবই ধীরে পাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বন্ধুত্ব আবশ্যিকভাবেই অংশীদারত্ব।’ তবে এ নিয়ে তাঁর এই উক্তিটিই বোধ হয় দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় যে, ‘বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই দেহে বাস করা এক আত্মা।’

কথায় আছে, মানুষ চেনা যায় তাঁর সঙ্গী-সাথি দেখে। অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য সুপরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ষোড়শ প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনও খানিকটা এরকমই বলেছিলেন। তাঁর মতে, ‘একজন ব্যক্তির জীবনের ভালো দিকটা গড়ে ওঠে তাঁর বন্ধুত্ব দিয়ে।’

কিন্তু এই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা যেমন সহজ কথা নয় তেমনি তা ধরে রাখাও সহজ কথা নয়। এজন্যই মনে হয় বলা হয়ে থাকে যে, বন্ধুত্ব হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের মতো; হারালেই কেবল এর মূল্য অনুধাবন করা যায়। কোনো ব্যক্তি বিপদে পড়লে যেমন তাঁর প্রকৃত বন্ধুদের চেনা যায়। তেমনি সাফল্যের কারণেও বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তা সে যে কারণেই হোক। আইরিশ লেখক-কবি ও নাট্যকার অস্কার ওয়াইল্ড বোধ হয় এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছিলেন, ‘বন্ধুর দুর্দশায় সহমর্মী হতে যে কেউই পারে, কিন্তু বন্ধুর সাফল্যের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে খুবই অনন্য প্রকৃতির সহমর্মিতা প্রয়োজন হয়।’

ফলে, ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন পাশাপাশি পা ফেলে চলতে না পারলে বন্ধুত্ব ধরে রাখা কঠিন হতেই পারে। ফরাসি দার্শনিক ও লেখক আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত উক্তি দিয়েই এ আলোচনা শেষ করা যেতে পারে। কামু বলছেন, ‘আমার সামনে সামনে হেঁটো না, আমি হয়তো অনুসরণ করব না। আমার পেছন পেছন হেঁটো না, আমি হয়তো পথ দেখাতে পারবে না। আমার পাশে হাঁটো এবং বন্ধু হও।’

Comments

Popular posts from this blog

Swadinota

The Art of Story-Telling by Richard Steele