এখানকার জল অন্যরকম

এখানকার জল অন্যরকম। বুড়োবাবা বলেন, নতুন জল।
টাপু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। ওদের ডিঙিটার থেকে চারপাশের অগাধ জল ভোরের আলোয় কী অদ্ভুত সোনালি-বেগুনি লাগছিল। তীর পেরিয়ে চলে এসে এখানটায় তেমন ঢেউ নেই। সবকিছু শান্ত, নরম।
এই সময়টায় টাপুর কেমন যেন মনে হয়। কোনো কাজ না করে ডিঙিতে চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে ইচ্ছে হয়।
কিন্তু সে উপায় নেই। ভোর না হতেই বড়নৌকো থেকে ওরা ডিঙি খুলে নিয়ে চলে এসেছে আরও ভেতরে। এখানেই ওদের সারাদিনের কাজকারবার। কাজ হয়ে গেলে আবার ফিরে যাওয়া বড়নৌকোতে।
ডিঙি বললেও আসলে এটা একটা অদ্ভুত বাক্স-মতো নৌকো। কত পুরোনো, কেউ জানে না। এর ভেতরে জিনিসপত্র রাখার জায়গা আছে, একটা ঘেরা ছাউনিও আছে - তিন-চারজন এঁটে যায়। এ-ধরণের নৌকোকে আসলে কী বলে, জানে না টাপু। বুড়োবাবা ডিঙিই বলেন। দেখাদেখি ওরাও বলে। এ-রকম ডিঙি ওদের বড়নৌকোর সাথে আরও তিনটে আছে।
কাঁধে একটা ছোঁয়া পেয়ে চমক ভাঙল টাপুর। পেছনে বিকো। হাসছে। বলল, কী রে, পিপি-র কথা ভাবছিস বুঝি?
টাপু রেগে উঠল - ধুর, যতসব ইয়ার্কি। খামোখা পিপির কথা ভাবতে যাব কেন? পিপি তো বন্ধু!
বিকো না দমে হাসতে হাসতে বলল - ওইজন্যই পিপির নাম শুনে গাল লাল হয়ে যাচ্ছে বাবুর! যাক গে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ড্রেস করে নে। আজ সারাদিন অনেক কাজ।
টাপু কথা না বাড়িয়ে উঠে গেল। ঘেরা ছাউনির পিছনে ওর আর বিকোর ডুবুরি পোষাক আছে। গভীরে ডোবা যায়, এমন পোষাক। পোষাকগুলো অদ্ভুত। পুরোনো, মোটা, রংচটা। বেশিক্ষণ পরে থাকলে ঘাম হয় খুব। পিঠের ট্যাঙ্কের সাথে লাগানো নলগুলো নোনাজলে শক্ত হয়ে গিয়েছে অনেকদিন আগেই। হেলমেটটার কাচ ঘোলাটে হয়ে এসেছে, মাথায় লাগানো আলোটাও হলদেটে হয়ে এসেছে কেমন। ওটা মাথায় পরলেই একটা অন্যরকম গন্ধ পায় টাপু। অন্য কোনো সমুদ্রের গন্ধ। এখানকার মতো নয়। টাপু সমুদ্রের গন্ধ আলাদা-আলাদা করে চিনতে পারে।
ডিঙি থেকে একটা শক্ত তারও ঝোলে। কোনো বিপদ হলে, বা সঙ্গে ভারী কিছু থাকায় উঠতে অসুবিধে হলে, এই তারে টান দিলে ডিঙিতে থাকা নোনো আর বিজা-দা বুঝতে পারে। ওরা তখন টেনে তোলে।
বিজাদাই ওদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। ও নিজেও ভালো ডুবুরি। কিন্তু বুড়োবাবা বলেছেন বলে, ওদের সঙ্গে আছে কয়েক মাস। শিখিয়ে-পড়িয়ে দিতে। মাঝে মাঝে বিকো বা টাপুর একজনকে নৌকোয় রেখে বিজাদাই নামে অন্যজনের সাথে। শিখিয়ে দ্যায় সহজে নামা, ওঠা, হঠাত কোনোকিছু আক্রমণ করলে সহজে পাশ কাটানো বা লড়াই করার কৌশল, নিরীহ আর ভয়ঙ্কর প্রাণী চিনতে শেখা, আর সবচেয়ে জরুরি - ডুবে থাকা বাড়িঘর, জিনিসপত্র চেনা, খুঁজে আনা।
টাপু আর বিকোর অল্প বয়স। দুজনে প্রায় একই বয়সী। ওরা জানে না, ওদের বাবা-মা কারা। ওদের বাড়ি ডাঙায়, না অন্য কোনো বড়নৌকোতে, ওরা জানে না। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বুড়োবাবার বড়নৌকোতেই ওরা থাকে। শুনেছে, যে-সব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ের নিজের কেউ নেই, খবর পেলে তাদেরকে বুড়োবাবা নিজের বড়নৌকোয় নিয়ে আসেন। নিজের কাছেই রাখেন। খাওয়ান, পরান, বড় করে তোলেন। পড়াশুনোও শেখান। টাপু শুনেছে, অনেক অনেক উঁচু ডাঙায় নাকি পড়াশুনো শেখানোর আলাদা বাড়ি আছে। সেগুলোকে ইসকুল বলে। টাপু অবশ্য দ্যাখে নি কখনো। ডাঙায় তো খুব বেশি যায়ই না ওরা, গেলেও ওই, মোহনা বা পাড়। ওদের মতো অনেকেই এখন জলেই থাকে। বাড়ির মতো বিশাল বিশাল নৌকোয়। ওরা বলে, বড়নৌকো। সমুদ্র থেকেই বিশেষ বিশেষ মিষ্টি শ্যাওলা আর মাছ খেয়ে ওদের চলে যায় দিব্যি।
ওদের বড়নৌকোয় বাইশ-তেইশজন থাকে। নানা বয়সী ছেলেমেয়ে। বুড়োবাবা সবাইকে খুব ভালোবাসেন। হাতে কাজ না থাকলে সবার সাথে কথা বলেন, গল্প করেন। মাঝে মাঝে নিজের ঘর থেকে একটা অদ্ভুত যন্ত্র বের করে আনেন। চালালে দেওয়ালে ছবি পড়ে। উনি অনেক ছবি দেখান - কতশত পুরোনো জীব জন্তু, যাদের অনেকগুলোই আর দেখা যায় না। কত পুরোনো বাড়িঘর, পৃথিবীর নানা দেশের, যার সবই আজ জলের তলায়! উঁচু ডাঙার কার কাছ থেকে যেন বুড়োবাবা নিয়ে এসেছিলেন যন্ত্রটা।
বুড়োবাবার ঘরটা এরকমই নানা অদ্ভুত জিনিসে বোঝাই। টাপুর খুব ইচ্ছে, একদিন ভালো করে সবকটা জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে দেখবে। কিন্তু বুড়োবাবা ওদের হাত দিতে দ্যান না। ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, বলেন সবকটাই অনেক পুরোনো জিনিস, ঠিকমতো না ধরলেই নাকি ভেঙে যাবে। জলের তলা থেকে ওদের তুলে আনা কিছু কিছু জিনিসও বুড়োবাবা রেখে দ্যান ঘরে। আর বাকিগুলো বিক্রি করে দ্যান মাঝে মাঝে ডাঙায় গিয়ে। তার থেকেই ওদের খাওয়াপরা, জিনিসপত্র আসে। দাদাদের কয়েকজনকে নিয়ে গিয়ে বুড়োবাবা কিনে আনেন।
বুড়োবাবার বড়নৌকোর সবাইই প্রায় ডুবুরির কাজ করে। বুড়োবাবাও আগে করতেন। বিজাদাদের নাকি বুড়োবাবাই শিখিয়েছিলেন সব। এখন অবশ্য জলে নামেন না আর। বয়স হয়েছে। তবে সমুদ্রের নাড়িনক্ষত্র চেনেন। সারা বছর ওদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান পৃথিবীর এ-সমুদ্র থেকে ও-সমুদ্রে। খোঁজেন, কোথায় নতুন জল। সেখানেই ডুবুরিদের কাজ। অন্য অনেক বড়নৌকোও ডুবুরিগিরি করে বটে, তবে বুড়োবাবার মতো জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা কারো নেই। বুড়োবাবার মতো এ-সমুদ্র থেকে ও-সমুদ্র ঘুরেও তারা বেড়ায় না। বুড়োবাবা মাঝে মাঝে বলেন, আমরা সবাই এখন সমুদ্রের সন্তান।
বুড়োবাবাই ওদের বলেছেন, এখন যেগুলোকে নতুন জল বলেন উনি, তিন-চারশো বছর আগেও ওগুলো নাকি ডাঙা ছিল। তারপর আস্তে আস্তে চলে গিয়েছে সমুদ্রের তলায়। জল বাড়তে বাড়তে এসে খেয়ে নিয়েছে অনেকখানি জায়গা। এ-রকম নতুন জল পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বুড়োবাবা সেগুলোর একটা থেকে আরেকটায় ঘুরে বেড়ান ওদের নিয়ে।
তিন-চারশো বছর ধরে সমুদ্র আর তার বাসিন্দারা অধিকার আর ক্ষয় করার পরেও, এখনও জলের তলায় রয়ে গিয়েছে পুরোনো বাড়িঘরদোরের ধ্বংসাবশেষ, রাস্তাঘাটের চিহ্ন। ওরই মধ্যে কাজ করে টাপুরা। ভাঙা বাড়িঘরগুলোর ভেতরে ঢুকে খুঁজে আনে নানা ধরণের তৈজসপত্র। তবে ওদের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য থাকে স্ট্রংবক্সের ওপর।
স্ট্রংবক্স হচ্ছে ছোটো বা মাঝারি আকারের ভারী বাক্স, ধাতুর তৈরি। কম্বিনেশন লাগানো। এগুলো খুঁজে পেলে প্রচুর লাভ হয়। বিকো আর টাপু তো গতমাসেই একটা বাক্স পেয়েছিল, নিয়ে ওঠা যাচ্ছিল না, এত ভারী, জলের তলায় হওয়া সত্ত্বেও। বড়নৌকোয় গিয়ে খুলে দেখা গিয়েছিল, সোনার বাটে ঠাসা। বুড়োবাবা বলেন, এই শহরগুলোয়, শেষের দিকে, যখন সমুদ্র খেয়ে নেয় নি পুরোপুরি, তখন বন্যা হতো হঠাত হঠাত। মানুষজন সবাই বুঝতে পেরেছিল, আর বেশিদিন নেই। সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল, চুরি-ডাকাতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল চারদিকে। তার ওপর শুরু হয়েছিল থেকে থেকেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর বন্যা। তখন এই স্ট্রংবক্সের চল খুব বেড়ে যায়। এগুলো সহজে ভাঙা যেত না, আর জলনিরোধকও ছিল, বন্যার কথা ভেবেই। সবাই নিজেদের সবচেয়ে দামী জিনিসগুলো রাখতে শুরু করেছিল এগুলোতে। তারপর হঠাত একদিন প্রবল বন্যা হলো, অনেক উঁচু ঢেউয়ের। সে জল আর ফিরে গেল না। ডুবে যাওয়া এরকম অনেক বাড়িতেই এক বা একের বেশি স্ট্রংবক্স পাওয়া যায়, এখনও। ভালো মানের বাক্স হলে সেগুলো জল থেকে তুলে আনার পর খুলে ফেললে দেখা যায়, ভেতরে একফোঁটাও জল ঢোকে নি।
আজকেও টাপু আর বিকো এরকমই একটা জায়গা বেছে নিয়েছিল যেখানে অনেক বাড়িঘর থাকতে পারে। এখানকার গভীরতা বেশি না, একশো ফুট মতো। অনেকটা অঞ্চল জুড়েই তাই। গতকাল সন্ধ্যেয় এখানে এসেছেন বুড়োবাবা। আগে কখনো আসা হয় নি এখানে, আশা করা যায় প্রচুর জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। একটা উঁচু শক্ত চুড়ো মতো জেগে ছিল জলের ওপরে, তাতেই বড়নৌকো বাঁধা হয়েছে। চারটে ডিঙি ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়েছে বড়নৌকোকে কেন্দ্র করে চারটে দিকে। পিপিও আছে তাদের একটায়।
ঝাঁপ মারার পর তলায় নামতে একটু সময় লাগে। চারদিকে ঘোলাটে নীল জলের মধ্যে নিজেকে ছেড়ে দিলে শরীরটা হাল্কা হয়ে আসে ক্রমশঃ। মোটা পোষাক ভেদ করে একটা আলতো ঠাণ্ডা ভাব চেপে বসে চামড়ায়। এই সময়টায়, এই কয়েকটা সেকেন্ডের মধ্যেই টাপুর পিপির কথা মনে হয় আজকাল। হেলমেটের ভেতরের পুরোনো সমুদ্রের গন্ধ বদলে গিয়ে পিপির গায়ের গন্ধের মতো হয়ে যায়।
বড়নৌকোর সবারই গায়ের গন্ধ একই রকম। নোনা-লাগা ক্ষয়াটে চামড়া, সমুদ্রের আঁশটে গন্ধ। কিন্তু তার মধ্যেও টাপু পিপির গন্ধ আলাদা করে চিনতে পারে। ভারী ভালো লাগে। ওর মনে হয়, ওই গন্ধের জন্যই ডাগর চোখের মেয়েটার কাছে সারা জীবন বসে থাকা যায়।
কিন্তু আজকাল পিপির কথা মনে হলে একটা ভারী মনখারাপও আসে। সামান্য কারণে ঝগড়া হয়ে গিয়েছে ওদের। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। পিপি এখন টাপুকে দেখলেই অন্যদিকে চলে যায়। টাপুও ঠিক করে নিয়েছে, সে-ও নিজে থেকে কথা বলবে না আর। যত কষ্টই হোক।
জলের তলার মাটি ছোঁয়ার পর টাপু আর বিকো চারদিকটা ভালো করে দেখছিল। ছোটো-বড়ো অনেক বাড়ির ধ্বংসাবশেষ, বহুযুগের প্রবালে, শ্যাওলায় ঢাকা। রঙিন সি-অ্যানিমোন আর ছোটোছোটো গাছগুলো হাল্কা স্রোতে এদিক-ওদিক দুলছে। অনেক ছোটো আর মাঝারি মাছ ঘোরাঘুরি করছে ক্ষিপ্রগতিতে। দেখতে ভালোই লাগে। সবচেয়ে অদ্ভুত লাগে বাড়িগুলোর কথা ভাবলে। কারা থাকবে বলে বানিয়েছিল, আর কারা থাকছে! টাপু জানে, বাড়িগুলোর ভেতরে আধো-অন্ধকার বা অন্ধকারে অনেক মাছ লুকিয়ে থাকে। তাদের কেউ শিকার, কেউ শিকারী। থাকতে পারে অক্টোপাস বা বিষধর সামুদ্রিক সাপও। টাপুরা তাই নামার সময় হাতে নিয়ে নামে ধারালো কাস্তের মতো একটা ভারী অস্ত্র - দরকারে আত্মরক্ষাও করা যায়, আবার কোথাও অল্প ভেঙে, কেটে পথ করে নেওয়া - তা-ও চলে। আজও তাই হাতে নিয়েই দাঁড়াল ওরা। সাবধানে। সবচেয়ে কাছের যে বাড়িটা, ভীষণভাবে ক্ষয়ে গেলেও এখনও দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে, তারই হাঁ-করা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুজনে একসাথে আলো জ্বালাল। তীব্র উজ্জ্বল আলো। ভেতরের প্রাণীগুলো চমকে উঠে পালিয়ে গেল দূরে।
খুব সন্তর্পণে ভেতরে ঢুকল দু-জন। বাড়িটা খুব বড় না, তবে বেশ কিছু ঘর আছে। কিছু ইতস্তত মাছ, চিঙড়ি আর কাঁকড়া ছাড়া তেমন কিছু নেই ভেতরে। পায়ের তলায় প্রবাল আর চুনাপাথরের জমে থাকা স্তরের সঙ্গে মিশে যাওয়া বালি। খুঁজে খুঁজে, মেঝেয় জমে থাকা স্তর সরিয়ে বেশ কয়েকটা এখনও প্রায় আস্ত জিনিস উদ্ধার করল ওরা - ভীষণভাবে ক্ষয়ে যাওয়া বাসনপত্র, একটা ছুরি...। তারপর এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে টাপুই প্রথম দেখল বাক্সটাকে।
শ্যাওলা আর চুনাপাথরের আস্তরণ, আর ছোটো ছোটো শামুক-ঝিনুকের বাসা সত্ত্বেও বাক্সটা অন্য আর-পাঁচটা বাক্সের মতো নয়। একটু বেশি দামী হয় এই বাক্সগুলো, টাপু জানে। আকারটাও একটু আলাদা। বিকোকে ডেকে দেখাল ও। তারপর দুজনে মিলে টেনে আনল বাইরে। খুব একটা ভারী কিছু নয়। অনেক সময় কাগজের নোট থাকলে এমন হয়।
তারের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে টান দিল ওরা। তরতর করে উঠে গেল বাক্সটা। তারপর তারটা আবার নেমে এলে, পাশের আর-একটা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল দু-জন।
ঘন্টাখানেক আরও খোঁজাখুঁজি করে আরও দুটো বাক্স পাওয়া গেল পাশের দুটো বাড়ি থেকে। তিনটে বাক্স হয়ে যাওয়ার পর ওরা দুজন উঠে এল ডিঙিতে। আবার বড়নৌকোয় ফিরে গিয়ে ট্যাঙ্কে গ্যাস ভরে আনতে হবে। ওখানে গ্যাস ভরার যন্ত্র আছে।
নোনো আর বিজাদা ইতিমধ্যে ঘষাঘষি করে সাফসুতরো করে ফেলেছে বাক্সগুলোকে। বাক্সগুলোর মধ্যে প্রথম তোলা বাক্সটাই সবচেয়ে ভালো। বাইরেটা ভীষণভাবে ক্ষয়ে গেলেও, কিছু কিছু জায়গায় আবছা নকশার মতো এখনও দেখা যাচ্ছে।
বড়নৌকোয় ফিরে এসে ওরা দেখল, বাকি ডিঙির লোকজন ফিরে এসেছে আগেই। বুড়োবাবা সবার সামনে বাক্সগুলো খুলছেন, দেখছেন ভেতরে কী কী আছে। বেশ কিছু গয়নাগাঁটি ডাঁই করা রয়েছে।
ওরা চারজনও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বাক্সগুলো নিয়ে। টাপুর হাতে বড় বাক্সটা দেখে বুড়োবাবা ওর চুলগুলো ঘেঁটে দিলেন একটু। তারপর বললেন, আজ এটা সবার শেষে খুলব।
বাকি সব বাক্সগুলো খোলা হলো এক-এক করে। টাপুদের আনা দুটো বাক্সও। দুটো থেকেই গয়নাগাটি পাওয়া গেল বেশ কিছু। সবশেষে বড় বাক্সটার পালা।
সবাই উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল। বিজাদা যখন বাক্সটার জং ধরা কব্জা ছেনি-হাতুড়ির জোর ধাক্কায় ভেঙে ফেলল, সবাই ঝুঁকে পড়ল ভেতরে।
না, কোনো সোনা, গয়না, কাগজের নোট - কিচ্ছু নেই। বাক্সটার খটখটে শুকনো বুকের ভেতর একটা বহু পুরোনো ছবি - তাতে দুজন ছেলেমেয়ে, টাপুদের থেকে বয়সে একটু বড়ো হয়তো - একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাসছে। আর একটা কাগজ। দুটোই ল্যামিনেট করা। আর কোনোকিছুই নেই।
সবাই হতাশ একটা আওয়াজ করল। টাপু মুষড়ে পড়ল সবচেয়ে বেশি। ওর মনে হয়েছিল, এটা থেকে হয়তো অনেক কিছু পাওয়া যাবে। ও একবার এদিক-ওদিক তাকালো। জমায়েতের ভেতর পিপিও ছিল। চোখাচুখি হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিল। খারাপ লাগাটা আরও বেড়ে গেল টাপুর।
বুড়োবাবা ইতিমধ্যে কাগজটা তুলে নিয়েছিলেন। চোখ বুলিয়ে বললেন - এ তো দেখছি অনেক পুরোনো দিনের লেখা! তবে পড়তে পারব। এ ভাষায় কিছু কিছু লেখা পড়েছি। উঁচু ডাঙায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষজনের মধ্যে কয়েকজন এখনও কথা বলে এ ভাষার নতুন রূপে।
ধীরে ধীরে মনে মনে পড়ছিলেন বুড়োবাবা। সবাই দাঁড়িয়ে ছিল। হারিয়ে যাওয়া উৎসাহটা আবার ফিরে এসেছে। অনেক সময় লোকে অন্য জায়গায় আরও সম্পত্তি লুকিয়ে রেখে স্ট্রংবক্সে তার ম্যাপ বা ঠিকানা রেখে গিয়েছে - এমনও হয়, টাপুরা জানে। তাই ওরা অপেক্ষা করছিল। দেখা যাক, কী বলেন বুড়োবাবা।
পুরোটা পড়া শেষ করে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন বুড়োবাবা। সবাই অবাক হয়ে দেখল, বুড়োবাবাকে কেমন অন্যরকম লাগছে। আর-একবার এগিয়ে এসে, ম্লান হেসে টাপুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। বললেন - মন খারাপ করিস না, টাপু। আজ অব্দি পাওয়া সবচেয়ে দামী বাক্স এটাই।
সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠল। বিকো তো জিগ্যেস করেই ফেলল, কী আছে ওতে বুড়োবাবা? গুপ্তধনের ম্যাপ?
বুড়োবাবা বললেন, পড়ে শোনাচ্ছি। শোন। বুঝতে পারবি।
"প্রিয় মিঠাই,
অনেক কিছুই রেখে যেতে পারততবু শেষমেশ কাগজই ধরলাম তোর জন্য। তোর মনে আছে, শিক্ষাদপ্তর থেকে লেখালিখি তুলে দিয়ে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় পরীক্ষা চালু করার পরও তুই-আমি দুজনেই লেখালিখি ভালো লাগত বলে, হলোগ্রাফিক কনফারেন্স না করে চিঠিই লিখতাম? সে অভ্যেস চলে গিয়েছে অনেকদিনই। তবু মনে হলো, তোর জন্য একটা শেষ চিঠি লিখি।
এ-চিঠি তুই হাতে পাবি না এখন। তুই চলে যাচ্ছিস উঁচু ডাঙায়। জানি, এখানে থাকতে তোর আপত্তি ছিল না কোনো। কিন্তু তোর বাবা-মা তোকে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি জানি, তুই ওঁদের কথা ফেলতে পারিস না।
গত কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করেছিস। আমার কাছে, বাবা-মায়ের কাছে, ঘরে শুয়ে বা বাথরুমেও একা একা কেঁদেছিস, জানি। কিন্তু উপায় নেই। তোর বাবা-মা এমনিতেই আমাকে খুব-একটা পছন্দ করেন না। প্রভাবশালী বলে ওঁরা যে-রকম সহজে উঁচু ডাঙায় থাকার জায়গা জুটিয়ে নিয়েছেন, আমার জন্য তুই বললেও তা করবেন না। করলেও আমি নেবো না। আমি বড় জেদি, তুই জানিস। আর নিজে নিজেও ওই নোংরামো, তেল দেওয়া, ঘুষ দেওয়ার রাজনীতি করে, একা বাঁচার লাইসেন্স আমি কিনতে পারব না রে।
শহরে বন্যা এবার খুব শিগগিরই আসবে শুনছি। সবাই বলছে, এবারের বন্যাই নাকি সবচেয়ে বড়ো বন্যা। অনেকে এ-ও বলছে, জল নাকি আর না-ও সরতে পারে কোনোদিন। উঁচু ডাঙায় পালাবার হুড়োহুড়িটা তাই বেশি। কিন্তু জানিস, চেষ্টা করলেও যেতে পারব না আমি। বাবা মা মারা যাওয়ার পর তাঁদের স্মৃতি জড়ানো এই তিনকামরার একতলা বাড়ি ছেড়ে শুধু নয়, শহরটাকে ছেড়ে, লোকগুলোকে ছেড়ে আমি টাকার জোরে পালিয়ে যাব এই বিপদের সময়? না রে মিঠাই, তা হয় না।
বরং আমি এখানেই থাকি। বন্যা এলে নিজে যতটুকু সাহায্য করতে পারি বাকিদের, করব। আরও কোটিকোটি অসহায় লোক এ-ওকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করব, প্রত্যেকবারের মতোই।
জল সরে গেলে যদি কোনোদিন আমায় খুঁজতে ফিরে আসিস, তাহলে এই বাড়িতে আসবি, জানি। তখন যদি আমি না থাকি, তাহলে এই চিঠিটা তোর জন্য রইল। সঙ্গে আমাদের একসাথে তোলা প্রথম ছবি - যদি আমার মুখটা তখন ভুলে যাস, মনে করানোর জন্য। ওটাও কাগজে ছেপেই রাখলাম। যদি না আসিস, যদি বহু বহু শতাব্দী কেটে যায়... তাহলে হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে একদিন। যেমন আমরা সবাই হয়ে যাচ্ছি অনেকদিন ধরেই।
খুব ভালোবাসি।
ইতি - তোর নোনতা।"
চিঠি শেষ করার পর বুড়োবাবা চুপ করে রইলেন অনেকক্ষণ। বাকি সবাইও চুপ।
টাপুর গলার কাছটায় কেমন কষ্ট হচ্ছিল। ও আবার তাকিয়ে দেখল, সামনে পিপি ওরই দিকে তাকিয়ে। টাপু তাকাতেও চোখ সরিয়ে নিল না। ওর ডাগর চোখগুলো ছলছল করছিল। আরও সুন্দর লাগছিল পিপিকে।
টাপু ঠিক করে নিল, পিপির সাথে ঝগড়া মিটিয়েই নেবে এবার।
এগোতে এগোতে শুনতে পেল, বিকো জিগ্যেস করছে, লোকটা কী পাগল ছিল, বুড়োবাবা?
বুড়োবাবা হেসে বললেন, তা বলতে পারিস। আমি যতটুকু জানি, পড়েছি, এখানে এককালে এমন পাগলের সংখ্যা কম ছিল না।
এখানে মানে?
দাঁড়া।
বুড়োবাবা নিজের ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এলেন একটা মোটা বই নিয়ে। বই জিনিসটা বুড়োবাবার দৌলতেই ওরা চেনে, নইলে আজকাল আর কাগজে পড়াশোনা হয় না কোথাও।
খুব পুরোনো, হলদেটে পাতাগুলো সন্তর্পণে উলটে একজায়গায় এসে থেমে গেলেন উনি। বিকোকে ডেকে বললেন, দ্যাখ, দেখতে পাচ্ছিস আমাদের বড়নৌকোটা কার সাথে বাঁধা?
হ্যাঁ, একটা লম্বা, খুব মোটা থামের মতো।
হ্যাঁ, এবার এই ছবিটা দ্যাখ। মনে আছে, প্রোজেক্টরে ফেলেও একবার দেখিয়েছিলাম? কয়েকশো বছর ধরে নোনা হাওয়ায় প্রচণ্ড ক্ষয়ে গিয়েছে যদিও, তবু চিনতে পারবি।
বিকোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
- চিনতে পেরেছি বুড়োবাবা।

Comments

Popular posts from this blog

Swadinota

The Art of Story-Telling by Richard Steele